শতবর্ষে বাংলা সাহিত্যে সত্যজিত রায়ের অবদান
ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল
১৯৪১ সাল। তখন তাঁর বয়স মাত্রই কুড়ি । “অ্যাবস্ট্রাকশান” নামে একটা ইংরাজী গল্প দিয়ে সাহিত্য জগতে প্রথম পা রাখা ।এর পরে অনেক বছর সাহিত্য জগতে তাঁর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় নি । বাংলা সাহিত্য রচনা শুরু করলেন ১৯৬১ সালে পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায়চোধুরীর “সন্দেশ” পত্রিকাটি নবকলেবরে প্রকাশ করে। তাঁর ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় যৌথ সম্পাদনাতে সন্দেশ আবার প্রকাশিত হল । এই পত্রিকাতে লিয়রের ছড়া অনুবাদ প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখা শুরু করেন ।এর পর থেকে তিনি নিয়মিত লেখালেখি শুরু করে দেন । একের পর এক সুখপাঠ্য ও ক্লাইমেক্সে পরিপূর্ণ ছোট গল্প গোয়েন্দা কাহিনীর বুননে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন । এছাড়াও লেখেন অজস্র ছড়া, প্রবন্ধ, কিশোর উপন্যাস , গোয়েন্দা রহস্য গল্প । সাহিত্যজগতে তাঁর আবির্ভাব বিলম্বিত হলেও তাঁকে স্বাগত জানাতে বিলম্ব করেন নি পাঠকরা । তাঁর প্রতিটি লেখাই প্রথম থেকে অধিকার করে নিয়েছে পাঠকের পরিপূর্ণ মনোযোগ । যদিও এই বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রস্রষ্টা্র সৃষ্টির বহুমুখী ধারার কাজের অন্যতম একটা কাজ ছিল সাহিত্য সৃষ্টি । এছাড়াও তিনি অজস্র চিত্রনাট্য লিখেছেন, ছবি তুলেছেন, ছবি একেঁছেন, সঙ্গীত রচনা করেছেন ও সুরসৃষ্টি করেছেন । তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার ছিল অপরিসীম, তাই তাঁকে জীবন্ত “এনসাইক্লোপিডিয়া” বলা হত । ইংরাজী ভাষাতে তাঁর অনেক গ্রন্থ ও লেখা প্রকাশিত হয়েছে । কল্পবিজ্ঞান কাহিনী, গোয়েন্দা কাহিনী, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিত্রনাট্য, সম্পাদিত , সঙ্কলিত ও অনূদিত গ্রন্থ মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৬০ এর অধিক। তাঁর যেকোন লেখার বা বইয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল বই ও লেখা জুড়ে ছবির পর ছবি থাকত । তিনি অসামান্য দক্ষতায় ইলাসট্রেশন বা হেডপিসে গল্পের মূল সুর বা চরিত্র প্রকাশ করতেন ।তিনি হেডপিসের মধ্যে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার করতেন , লেখার চরিত্র অনুযায়ী লেটারিংয়ের ধরন ঠিক করতেন । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় , “বাদশাহী আংটির” হেডপিস দেখলেই বোঝা যায়, এটা রহস্য কাহিনী আর তার কেন্দ্রে রয়েছে মুঘল আমলের কোনো আংটি । ছবির মাধ্যমে তিনি চরিত্র গুলির একটা নিখুঁত ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন । ছবির ফ্রেমিং, এমনকি রেখার চরিত্র লেখার চরিত্র অনুযায়ী পাল্টাতেন ।
বাংলা সাহিত্যকে তিনি জনপ্রিয় ও চিরন্তন দুটি চরিত্র উপহার দিয়েছেন – ফেলু দা ও প্রফেশর শঙ্কু । তাঁর প্রথম গ্রন্থ “প্রফেশর শঙ্কু” প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। শুরু থেকেই শঙ্কু কাহিনী পাঠকদের বিশেষতঃ কিশোর পাঠকদের মন জয় করে নিয়েছিল । পাশাপাশি গোয়েন্দা ফেলুদার রহস্য, রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার সব বয়সী পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠেছে । আশেপাশের চেনা মানুষগুলোই তাঁর গল্পে বারবার এসেছে । তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে কখনো সুপারম্যান মনে হয় নি। তাঁর মননের ছোঁয়ায় সাধারণ গল্প বারবার অসাধারণ হয়ে উঠেছে । তাঁর লেখার একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তাঁর লেখায় বারবার “মন্দ” হেরে যায় “ভালো”র কাছে, “অন্ধকার” হেরে যায় “আলো”র কাছে। ফেলুদার রহস্য কাহিনীই হোক বা প্রোফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার হোক বা তারিণী খুড়োর গল্পই হোক, বা অন্য কোন রচনা – তিনি কোথাও শেষ পর্যন্ত “মন্দ”কে জিততে দেন নি। তাঁর লেখার মৌলিকত্ব ছিল তুলনাহীন । তাঁর কোনো একটি রচনাকেও তুলনা করা যাবে না অন্য কোন রচনার সঙ্গে ।তাঁর বিভিন্ন উপাখ্যান গুলির কোনটিকে কখনো মনে হয়নি পুরোনোর অনুবৃত্তি ।শুধু মৌলিক রচনার ক্ষেত্রেই নয়, অনুবাদ রচনাতেও তাঁর লেখনী অনবদ্য । তাঁর অনুবাদ রচনা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠত অনুসৃষ্টি । রচনার নামকরণেও তিনি অনন্য হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর গল্পের সুন্দর-সহজ-অর্থবহ-শ্রুতিমধুর নামকরণ, গঠনরীতি ও ভাষার ব্যঞ্জনা গল্পগুলিকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে ।
খুব ভালো হয়েছে।