দেবীপক্ষের সূচনা।এই সার্বিক বোধকে অবলম্বন করেই হিন্দু বাঙালির কাছে মহালয়া আসে।পিতৃতর্পণের আনুষ্ঠানিকতাতে যাঁরা নিয়োজিত থাকেন, তাঁদের কাছে ও ধর্মীয় আচার আচরণের সাথে সাথে রেডিও তে ‘ মহিষারষুরমর্দিনী’ শোনা টা অনেকটা যেন ধর্মীয় আচারের ই অঙ্গ হয়ে ওঠে।পিতৃতর্পণের ধর্মীয় আচার আচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, এমন হিন্দু বাঙালি ও ‘ মহালয়া’ নামেই বেশি প্রচলিত ওই সঙ্গীতানুষ্ঠান শোনেন।হিন্দু ভাবধারার বাইরে , ধর্মে মুসলমান, জাতিতে বাঙালি, এমন মানুষজনেরাও গভীর আগ্রহের সঙ্গে ওই সঙ্গীতাঞ্জলি শোনেন।হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে যেমন ছেলেছোকরা দের ও একটা বড় আকর্ষণ ওই সুর আর বাণীর জাদুকে স্পর্শ করবার, তেমন ই ভালোবাসা, ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রবীণ বাঙালিদের ভিতরেও।মহালয়া ঘিরে ধর্মীয় আবেদন থেকে উত্তোরিত হয়ে, ওই রেডিওর অনুষ্ঠানকে ঘিরে একটা সামাজিক- সাংস্কৃতিক যে উন্মাদনা তৈরি হয়, তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, এমন কি দেশ কে ও অতিক্রম করে যায়।হিন্দু সমাজ তো বটেই , এপার বাংলার বাঙালি মুসলমানের মতোই , বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের কাছে ও আকাশবাণীর ওই সঙ্গীতানুষ্ঠান একটা অন্য ধরণের নষ্টালজিয়া তৈরি করে।
সামাজিক উৎসবকে ধর্মীয় লেবাস দিয়ে, সেই ধর্মকেন্দ্রিক মাতামাতির ধারা আমাদের বাংলার তথা গোটা দেশের ই রাজনৈতিক উত্থানপতনের ইতিহাসের সঙ্গে আষ্টিপিষ্টে বাঁধা পড়ে গেছে।আজ থেকে একশো দেশো বছর আগে ধর্মীয় কর্মকান্ডের ভিতরে সামাজিক উপাদান যতো তীব্র ভাবে ছিল, সময়ের প্রেক্ষিতে তা উবে যেতে শুরু করেছে।এই উবে যাওয়ার একটা বড় প্রবণতা হল, ভারতের জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনীতির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মিশেলের পর্যায়ক্রম গুলি।
মধ্যকালীন ভারতে পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা যেসব ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন, ধর্মের নিগূঢ় বেড়াজাল অতিক্রম করে, সেই আচার , নিরাচার গুলি ক্রমশঃ একটা সামাজিক দ্যোতনা তে উত্তরীত হতো।ধর্মের এককেন্দ্রিক বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে এসে, ঈদ , মুহররম ,বেড়া ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক এবং লৌকিক আচার গুলি , অনুষ্ঠানগুলি একটা সামাজিক উৎসবে পরিণত হতো।উৎসবের সার্বজনীনতায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কৌনিক অবস্থান অতিক্রান্ত হয়ে , উৎসবের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক মাত্রা সমাজজীবনের উপর একটা অন্যরকমের ছায়াপাত করতো।
এক ই ভাবে হিন্দু বাঙালিদের নববর্ষ , যাকে হালখাতা বলা হয়, এই অনুষ্ঠানটিও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় কোটরের বাইরে এসে মানুষের সার্বজনীন উৎসব হিশেবেই নিজেকে মেলে ধরতো।এই মিলনক্ষেত্রে হিন্দু- মুসলমানের প্রভেদ থাকতো না।থাকতো যেটা , সেটা হল; অভিজাত আর অনভিজাতের ফারাক।এই ফারাকে ধর্ম তেমন একটা বড় বিষয় হতো না।বড়ো বিষয় হতো, ট্যাঁকের জোর।হিন্দু- মুসলমান , উভয় বাঙালিই এইসব সামাজিক অনুষ্ঠানে ট্যাঁকের জোরের নিরিখে বিভক্ত হয়ে যেত।কাঞ্চনকৌলিন্যের জোরে বিত্তশালী মুসলমান আর হিন্দুতে যেমন একটা বড়ো কিছু বিভেদ থাকতো না, তেমনি ই না পাওয়ার কষ্টে গরীবগুর্বো হিন্দু আর মুসলমানেও খুব একটা ভেদরেখা থাকতো না।
অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু – মুসলমানের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির ভিতর থেকে একটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক রসাস্বাধনের তাগিদ ছিল।জাতীয় আন্দোলনের তীব্রতা প্রাপ্তির সাথে সাথে , হিন্দু- মুসলমানের ভিতরে রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্তি জনিত যে চাপান উতোর ,তা বল্গাহীন হয়ে ওঠার আগে , উভয় ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলির সাথেও সামাজিক মূল্যবোধ সঞ্চারণের একটা প্রয়াস ছিল।একদিকে যখন ইসলামীয় সংস্কৃতি লোকায়ত ধারার মিশেলে , সূফী সন্তদের প্রভাবে লোকায়ত ইসলামকে বাংলার আনাচে কানাচে সঞ্চারিত করছে, ঠিক সেই সময়েই পবিত্র ইসলামের পীর পরম্পরাকে হিন্দু সমাজের নীচের তলার মানুষ , পরম সমাদরে আপন করে নিচ্ছেন।সত্যপীর সত্যনারায়ণে র রূপ ধরে, মূলত অব্রাহ্মণ হিন্দুদের ঘরে পরম সমাদরে পূজিত হচ্ছেন।সিন্নি, যেটি মুসলমান ভাবধারার সঞ্চারণের আগে , হিন্দু বাঙালি জানতোই না, তা সত্যনারায়ণের একান্ত জরুরি প্রসাদ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এইসময়ে কিন্তু ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতা আর থাকছে না।’ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল, তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে, ছোঁওয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল’- কাজী নজরুলের এই আপ্তবাক্য যেন চরম সত্য হিশেবে আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে।
অবনীন্দ্রনাথ যখন বাংলার ব্রত গুলি সঙ্কলিত ঈরবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন গত শতকের মধ্যভাগে, ভাটপাড়ার রক্ষণশীল ব্রাহ্মণসমাজ তখন এই সত্যনারায়ণের ব্রতকে , বাঙালি হিন্দুর ব্রত হিশেবে সংযোজিত করবার ঘোরতর বিরুদ্ধাচারণ করেছিল।তার ও আগে, উনিশ শতকের শেষের দিকে, বাল গঙ্গাধর তিলক পুনে শহরকে কেন্দ্র করে বারোয়ারি গণপতি পুজোর প্রচলন করেন।সেই পুজো ক্রমে পুনে শহরের ভৌগলিক সীমাকে অতিক্রম করে বিস্তার লাভ করে সেযুগের বোম্বাই বা আজকের মুম্বাইতে।এই পুজোর বারোয়ারি রূপ দেওয়ার পিছনে সংগঠকদের বড়ো উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুদের ,মুসলমানেদের মুহররমের শোভাযাত্রার থেকে কায়দা করে দূরে সরিয়ে আনা।এই কায়দাবাজির খপ্পরে পড়েই সামাজিক সংস্কৃতি ক্রমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির তাগিদে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হতে থাকলো।ধীরে ধীরে মুহররমের মিছিল থেকে নিজেদের বিযুক্ত করতে থাকলেন হিন্দুরা আর জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে থাকলেন হিন্দুরা।ঢাকাতে তিনের দশকেও জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রাতে যেমন ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির আধিক্য দেখা যেত, পাকিস্থান ভাবনার বিকাশের সাথে সাথে সেই জন্মাষ্টমীর মিছিল থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলেন বাঙালি মুসলমানেরা ।আর মুহররমের মিছিল থেকে নিজেদের সরাতে শুরু করলেন বাঙালি হিন্দুরা।কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘ স্মৃতির শহর’ গ্রন্থে , তিনের দশক, চারের দশকের সূচনা পর্বে পুরানো ঢাকার জন্মাষ্টমী আর মুহররমের মিছিলে ধর্ম ব্যাতিরিকে বাঞালির অংশগ্রহণ আর মিছিলের আওয়াজ,’ এক নাড়া, দো নাড়া , বোলো বোলো ভেস্তা’ র অসাধারণ স্মৃতি রোমান্থন করেছেন।
একদিন বাঙালি ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে উন্নীত করেছিল সামাজিক আঙিনাতে।ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, ভাষা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের বিদ্বেষ, লিঙ্গ বৈষম্য — অর্থনৈতিক বিভাজনের এইসব সোপানগুলি ক্রমেই সামাজিক পরিমন্ডলের সেই স্তরগুলিকে সঙ্কুচিত করেছে।ধর্মের ঔদার্যকে স্থানিক কৌনিক অবস্থানে দেখতেই অভ্যস্থ হয়ে উঠতে বাধ্য করা হয়েছে মানুষকে।তাই মহালয়ার সামাজিক আবেদন এখন আর জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির উপর বিচ্ছুরণ ঘটায় না তার বর্ণচ্ছটার।পৌরহিত্যের নিগঢ়ে পিতৃতর্পণ কে আবদ্ধ করে ধর্মের সামগ্রিক আবেদন কে পর্যবসিত করা হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদ আর পুরুষতন্ত্রের জগাখিচুড়ির ভিতরে।পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনে , ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কে কম্পালসারি করে, মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতেই ধর্মের সাম্রাজ্যতে জেল খানার মতো পাঁচিল তুলে দেওয়া হচ্ছে।অব্রাহ্মণ আর নারীর সেখানে প্রবেশ নৈব নৈব চ।সামাজিকতাতে ধর্মীয় দ্যোতনাকে উপস্থাপিত করবার যে উদার, মানবিক, বাস্তবসম্মত সামাজিক বিন্যাসের প্রচেষ্টা বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক সহ , সেইসময়ের প্রথিতযশা শিল্পী রা করেছিলেন, সেই ভাবধারাটাকে একটা নিছক আনুষ্ঠানিকতার ভিতরে এখন আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।এইসব শিল্পীরা একটা ধর্মীয় বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়েও একটিবারের জন্যেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষে নিজেদের বিদীর্ণ করেন নি।সেটা আমরা একবারের জন্যেও আজকের দিনে মনে রাখছি না।অথচ, এইটিই এখন আমাদের মনে রাখা সবথেকে জরুরি বিষয়।
