প্রশ্ন তুললেই ফসকাবে ইনাম
মোদি- মমতা সাক্ষাৎতে আনন্দবাজারের কাছে সব থেকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এঁদের দুজনের শরীর চর্চা জনিত আলোচনা।দেশের প্রধানমন্ত্রী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই দীর্ঘকাল পর বৈঠকে রাজ্যের দাবি দাওয়া পেশের যে কথা মমতা বলেছিলেন, সেই দাবি দাওয়া তিনি কতোটা সফল ভাবে দেশের প্রধানমনাত্রীর কাছে পেশ করতে পারলেন- সে নিয়ে আনন্দবাজারের কোনো মাথা ব্যথা নেই।তাঁরা তাঁদের কাগজের মহামূল্যবান তিন কলমের ও বেশি জায়গা খরচ করলেন মমতার ফিটনেস জনিত পাগলামো আর যোগের আন্তর্জাতিক ব্রান্ডিংয়ে উঠে মোদির উঠে আসার তথাকথিত গপ্পো দিয়ে।
রাজ্যের দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশের যে কথা মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন, সেই দাবি আদৌ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়েছে কি? আনন্দবাজার নীরব।তাঁরা ব্যস্ত মমতা রোজ কতো কিলোমিটার হাঁটেন – তাই নিয়েই।
রাজ্যের দাবি যদি সত্যি ই মুখ্যমন্ত্রী পেশ করে থাকেন, সেই দাবি গুলি কি ছিল? কেবলমাত্র রাজ্যের নাম বদলের মতো অরাজনৈতিক বিষয়, যে বিষয়ের সঙ্গে এন আর সি, বেকারি, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, রাজীবকুমার কে ঘিরে তৈরি অচলাবস্থা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরের আমলাদের ভিতরে তৈরি হওয়া চরম অনিশ্চয়তা– এইসব বিষয় ঠাঁই পেয়েছে কিনা, ঠাঁই পেলেও সেইসব দাবি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কি বললেন– এসব রাজনৈতিক প্রশ্নের ধারপাশ দিয়ে গেল না আনন্দবাজার।
বরংচ তাঁরা মমতার মুখ নিসৃত মোদি স্তুতি, তিনি মমতার শরীর চর্চার বিষয়েও কতোখানি ওয়াকিবহাল– তার আবেগঘন চিত্রমালা তৈরিতেই ব্যস্ত আনন্দবাজার।
সর্বত্র ই মানুষকে তাঁদের রুটি – রুজির লড়াই থেকে সরিয়ে দিতে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র চলছে।বি এস এন এলের কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে চরম দুরবস্থার ভিতরে আছেন।দেশব্যাপী আন্দোলন করছেন।কলকাতার বুকেও সেই আন্দোলন আছড়ে পড়ছে।সেই আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গ মমতার তাঁর এই দিল্লি সফরের আগে প্রকাশ্যে বলেছিলেন।
সেই প্রসঙ্গ তিনি কি আদৌ প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখতে পেরেছিলেন কুর্তা ইত্যাদি উপহার দেওয়ার ফাঁকে?
এই প্রশ্ন তোলার হিম্মৎ আনন্দবাজারের নেই।কারন, মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করে অরাজনৈতিক বিষয়- ব্যক্তি মমতার শরীর চর্চা, মমতা কর্তৃক মোদির ওজন হ্রাসের শংসা প্রদান– এগুলোকেই সাধারণ মানুষকে মজানো এখন আনন্দবাজারের কাছে পবিত্র কর্তব্য।
বলতে পারেন বন্ধু, মমতার দৈনিক কুড়ি কিলোমিটার হাঁটা বা মোদির শরীরের ওজন কমা নিয়ে শিয়ালদা স্টেশনের ফ্ল্যাইওভারের গায়ে পুরনো বই বিক্রি করা ইউসুফ, এন আর সি নিয়ে যাঁর বাবা , রাজাবাজারে আশি বছরের বেশি বসবাসকারী ইকবাল চাচা– যাঁরা সারা দিনের হাড় ভাঙা খাটুনির পর রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পর্যন্ত পারছেন না– তাঁদের কি হবে?
মুক্তোপুর শ্মশানে ঢোকার মুখে দীর্ঘদিন ধরে জুতো সেলাইয়ের কাজ করে বিনোদ।এস ওয়াজেদ আলির ‘ভারতবর্ষে’র মতো আগে ওঁর বাবা সত্তেন্দর করতেন।আজ বোধহয় পঞ্চাশ বছর ধরে নানা ঝড় ঝাপটাতে কাটানো সমাজের তথাকথিত এই অন্ত্যজ পরিবার টি সকালে দোকান খোলার সময়ে ভক্তি ভরে ধুপ দেয়, দিয়া জ্বালায় সন্ত রবিদাসের ছবিতে।সে কোন ছোটবেলায় , সাতের দশকের শুরু তে আমার সেই শিশুসত্তার সঙ্গে মধ্যকালীন ভারতের সমন্বয়ী চেতনার অন্যতম প্রতীক সন্ত রবিদাসের পরিচয় এই সত্তেন্দর মুচির দোকানে বসে করিয়ে দিয়েছিলেন আমার দাদু, বুঝিয়েছিলেন; গুরু গ্রন্থসাহিব থেকে দাদূ সম্প্রদায়ের সাধক– কতোখানি প্রেরণা পেয়েছিলেন বারাণসীর কাছে এক অজ পাড়া গাঁয়ে জন্ম নেওয়া এই মুচি পরিবারের মহাসাধকের কাছে।মায়ের বাবা দাদু আর সাধক দাদূ সম্প্রদায় সেদিন আমার শিশু চেতনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।বাড়িতে এসে দাদু তাক নেমে নামিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেনের ,’দাদূ’।তখন ভালো করে রিডিং পড়ার বয়স ও হয় নি।বইটির গায়ে কেবল হাত বুলিয়েছিলাম।
বিনোদের চোখে আজ জল।তাঁর আরাধ্য সন্ত রবিদাসের মন্দির আজ কোর্টের রায়কে হাতিয়ার করে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে পুলিশ খোদ দেশের রাজধানী দিল্লিতে।মমতা থেকে কেজরিওয়াল — কেউ প্রতিবাদ করেন নিএকমাত্র প্রতিবাদী ‘শূন্যে’নেমে আসা বামেরা।হাজার হাজার বিনোদদের এই চোখের জলের ভাষা মমতা কি পৌঁছে দিলেন দেশের দোর্দন্ড প্রতাপ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে? এই বিনীত প্রশ্ন ও আনন্দবাজার তোলে নি।কারন, প্রশ্ন তুললে ইনাম ফসকে যায়।
